বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের অনেকে উদ্বিগ্ন : যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের প্রতিবেদন

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

প্রতিমা ডেস্ক(২৩ জুলাই) :: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছেন। তবে সংখ্যালঘুদের অনেকেই তাদের সুরক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁরা সেই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

২২ জুলাই মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা এবং হয়রানি এখনো একটি সমস্যা।

জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত দুই হাজার ৯২৪টি হামলার নিন্দা করলেও আইন প্রয়োগকারী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে জবাবদিহির অভাব রয়েছে।

উপরন্তু হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আহমদিয়া ও সুফি মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরা বৈষম্যের শিকার হওয়ার তথ্য দিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কতটা যুক্ত তা এখনো স্পষ্ট নয়।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, সংস্কারপ্রক্রিয়ায় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বা তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি এবং রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কম।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে একজন হিন্দু এবং অন্য একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরোধিতার প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে।

হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কিছু গোষ্ঠী সুপারিশগুলোকে অনৈসলামিক বলে অভিহিত করেছে।

কিছু নারী শিক্ষাঙ্গনে রক্ষণশীল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। হেফাজতে ইসলামের আলটিমেটামের পর কলেজ শিক্ষক নাদিরা ইসলামকে অন্যত্র বদলি করা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চাপে গত ফেব্রুয়ারিতে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করার মতো ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।

সাইবার নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ওই আইনে ব্লাসফেমির অভিযোগে কয়েকটি গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে সোহেল হাসান গালিবকে গ্রেপ্তার, পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটির সদস্য রাখাল রাহার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে সিআইডিকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশের প্রসঙ্গও সেখানে স্থান পেয়েছে।

গত বছর জুলাই আন্দোলন ও এরপর ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়তে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা সম্পর্কে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা ভারতীয় গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর তথ্যকে দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কিছু হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়েছে, অগ্নিসংযোগ বা হিন্দু মহিলাদের ওপর আক্রমণের বানোয়াট ভিডিও দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বলেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে অবদান রাখছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিভ্রান্তিকর তথ্যের ব্যাপারে বেশি সংবেদনশীল। বিভ্রান্তিকর তথ্য তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল।

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তনের পর এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যা ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে বিভ্রান্তিকর প্রচারণাকে উসকে দিয়েছে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার এমনই একটি বিষয় হিসেবে কাজ করেছিল। চিন্ময় গ্রেপ্তারের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তিনি এটিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অধিকারের ওপর চলমান নির্যাতনের উদাহরণ হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যাঁরা ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে রিপোর্ট করছেন তাঁরাও ‘মব’ ও রক্ষণশীল গোষ্ঠীর দ্বারা হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইসলামবিরোধী অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ তুলে তাঁরা গত নভেম্বরে শীর্ষ স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা বন্ধের দাবি তুলেছিলেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের সময় ধর্মভিত্তিক সহিংসতার আশঙ্কা করছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পুলিশ মোতায়েনের বাইরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবেলায় কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করেনি। আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের সময়ও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত ছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি—দুই দলেরই ভোট পাওয়ার জন্য ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করার ইতিহাস রয়েছে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর কাজ বিদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরি করা।

প্রতিবেদন তৈরি করে বৈদেশিক নীতিসংক্রান্ত সুপারিশসহ কমিশন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেসের কাছে জমা দেয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কমিশনের প্রতিনিধিরা গত মে মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।