প্রতিমা ডটকম(২৮ জানুয়ারি) :: এবারের জাতীয় নির্বাচনেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে। দেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও কমিশন গঠন ছাড়া নির্বাচনকেন্দ্রিক সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারই একমাত্র সেটা করতে পারে।
গত শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন, সহিংসতা ও মানবাধিকার: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এমন মন্তব্য করেন। এ সময় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন গঠন করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এ সভার আয়োজন করে। সভায় বক্তারা বলেন, এই নির্বাচনেও বহু স্থানে বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিন্তে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী সরাসরি হিন্দু সম্প্রদায়কে হুমকি দিয়েছেন, ভোটকেন্দ্রে না যেতে বলেছেন। পরে বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, লুটপাট হয়েছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কিছু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। সেই নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে হিন্দুরা হামলার শিকার হয়েছেন। অথচ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে, যে নির্বাচন স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত গড়েছিল আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ জিতিয়ে, হিন্দু সম্প্রদায় বা অন্য কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়নি।
বক্তারা আরও বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুরা ভোট দিয়ে হামলার শিকার হয়, না দিলেও হয়। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বিএনপি-জামায়াত হামলা করে, বিএনপিকে ভোট দিলে আওয়ামী লীগের একাংশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর হয়, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নারীরা নির্যাতিত হন।
ভোট দেওয়ার অপরাধে বাড়িঘর ছাড়তে হয়, জায়গা-জমি বেদখল হয়ে যায়। এবারের সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত বর্জন করেছে। আশা করা গিয়েছিল নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ, হিন্দুরা আক্রান্ত হবে না। কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদাতা দল আওয়ামী লীগের একাংশের হাতেই হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ।
দুঃখ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি যেন নির্বাচনকেন্দ্রিক হামলা না হয়, সে বিষয়ে নির্বাচনের আগেও মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। আশা ছিল নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমরা কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছি। এ নিয়ে কোনো মতবিনিময় সভার প্রয়োজন হবে না বলে আশা করেছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য। সামনে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন হবে। আশা করছি, অতীতের সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, নির্বাচনে স্পষ্টভাবে সংখ্যালঘু ও হিন্দুবিরোধী, দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরা গোষ্ঠী সহিংসতা করেছে। সংখ্যালঘু সুরক্ষায় আইন ও কমিশন গঠন করা ছাড়া এ ধরনের নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের আমলেও সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়েছে। এর চেয়েও ভয়াবহভাবে হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের আমলে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে প্রশাসন সতর্ক ছিল। তারপরও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা হয়েছে। নির্বাচন বা পূজার মতো বিশেষ সময়ে সেটি তীব্র হয়। তিনি বলেন, অত্যাচারী জানে সহিংসতা করলেও পার পেয়ে যাবে। সেজন্যই নির্যাতন বেশি হয়।
সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সব নির্বাচনেই সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। এ সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সম্ভব নয়।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের অনেকে ক্ষমতাসীন দলের। কারণ এবার নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী অতি দ্রুত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিকের সভাপতিত্বে সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার। আরও বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ, নির্বাচনী সহিংসতার শিকার বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ।