প্রতিমা ডেস্ক(৪ অক্টোবর) :: শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে নির্বিঘ্নে শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্ক যেনো একটু বেশিই। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অতীতের তথ্য বলছে, দুর্গাপূজার দিন যতই ঘনিয়ে আসে এমন ঘটনাও বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে অক্টোবরের ৩ তারিখ পর্যন্ত ৬টি এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের তাম্বুলখানা বাজারের সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে; ২৩ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর কামান্না সরকারপাড়া মন্দিরে এবং একই দিন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের ভুরাখালী গ্রামের ভুরাখালী কালী মন্দিরে; ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের দুর্গা মন্দিরে এবং একই তারিখে নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া গ্রামের পুরুলিয়া ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা; ২ অক্টোবর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি ইউনিয়নের পোড়াহাটি গ্রামের বারোইপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বিবৃতিতে আসক উল্লেখ করে, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে দুর্গাপূজার প্রাক্কালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের বাড়ি-ঘর, প্রার্থনার স্থানে হামলার ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং তারা যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদযাপন করতে পারে, তা নিশ্চিতে প্রশাসনকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে আসক।
এদিকে ২০২১ সালে দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনে কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কুরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি জেলায় সা¤প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর করা হয় শতাধিক মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘর। ওই হামলার ঘটনায় শুধু নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরেই ৫৬টি মামলা হয়েছিল। এর অর্ধেক মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তারও হয়েছিল চার শতাধিক আসামি। কিন্তু অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে গেছে। সারাদেশে একটানা হামলার ওই ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এই রিট দিয়ে বিচারিক (জুডিশিয়াল) তদন্তের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু দেখা যায়, যখন এই তদন্তগুলো চলছিল তখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে হাইকোর্টের ওই আদেশকে স্থগিত করে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
এছাড়া ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্গোৎসব চলাকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক কর্মসূচি না দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ঐক্য পরিষদের আহ্বানে ইতোমধ্যে শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালে ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২৩ অক্টোবর নবমী পূজার দিন শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ ডেকেছে। এই সুযোগে সাম্প্রদায়িক শক্তি কোনো ধরনের সহিংসতা পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংখ্যালঘু নেতারা।
শারদীয় দুর্গোৎসবে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনসমূহের ঐক্যমোর্চার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতি বছরই প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে ২০২১ সালের মতো ব্যাপকভাবে হয়নি। এবছরও প্রতিমা ভাঙচুর শুরু হয়েছে। ২০২১ সালে ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে কুরআন শরিফ পাওয়ার অভিযোগে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছিলো তা ৩২টি জেলায় ছড়িয়েছিল।
যদিও ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম এরপরও কিছু দিন এই সহিংসতা চলেছে। আমরা লক্ষ্য করলাম ২০২২ সালে উৎসাহ উদ্দীপনায় শারদীয় দুর্গোৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি কথাই মনে হয়, যদি সরকার ও তার সমস্ত প্রশাসন চায়, দুর্গাপূজা চলাকালে সংখ্যালঘুদের দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করবে- তাহলে এটি তাদের পক্ষে সম্ভব। দুর্গাপূজা চলাকালে সব রাজনৈতিক দলকে ঐকবদ্ধ হয়ে একটি প্রতিরোধী ভূমিকায় আমরা দেখতে চাই।
২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রসঙ্গে রানা দাশগুপ্ত বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা সব রাজনৈতিক দলের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম। কারণ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে, দুর্গাপূজা চলাকালে যাতে সাম্প্রদায়িক শক্তি সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো হামলা করতে না পারে। বরং সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সংখ্যালঘু বা যেসব এলাকায় পূজা হচ্ছে সেগুলো পাহাড়া দেয়া। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
ইতোমধ্যে ঐক্য পরিষদের আহ্বানে ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এজন্য আমরা তাদের স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম, ২৩ অক্টোবর নবমী পূজার দিন আওয়ামী লীগ শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করবে। আমরা আশা করব মহাসমাবেশের তারিখ খানিকটা পিছিয়ে দিয়ে অন্তত দুর্গাপূজা চলাকালে এই কর্মসূচি থেকে তারা সরে আসবেন। সংখ্যালঘুদের শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব পালনে তারা একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি।
দুর্গোৎসের সময় সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে স্থগিতাদেশে আক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং ঐক্য পরিষদের সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একটানা চলল ১৩ দিন। এসব ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারিক তদন্তের আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু দেখা যায়, যখন এই তদন্তগুলো চলছিল তখন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে ওই হাইকোর্টের আদেশকে স্থগিত করে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
দুর্গাপূজার সময় এতগুলো জেলায় হামলা হলো হাইকোর্ট বিচারিক তদন্ত করল ৫টি জেলায়। সরকারের এমন কি গাত্রদাহ- ৫টি জেলায়ও বিচারিক তদন্ত হতে দেবে না? আপিল বিভাগ এ বিষয়ে স্থগিতাদেশ দিল। আমরা যাবটা কোথায়? হাইকোর্টে যৎসামান্য কিছু পেলে সেটি যদি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ বন্ধ করে দেয়; সেক্ষেত্রে আস্থার সংকট এখন বিচার বিভাগের ওপরও এসে গেল। এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে তো মনে হয় না।
এদিকে শঙ্কার মধ্যেও গত বছরের তুলনায় এবছর দেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর ৩২ হাজার ৪০৭টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১৬৮টি।

