করোনাকালে দুর্গাপূজা : প্রতিমা কারিগরদের ব্যবসায় ধস

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

প্রতিমা রিপোর্ট(১০ অক্টোবর) :: মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে জীবন-জীবিকায় টান পড়েছে। রঙ হারিয়েছে উৎসব। এর আগে, মুসলিম সম্প্রদায়ের দুই ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদযাপন হয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার পরিধিও ছোট হয়ে গেছে। ফলে কক্সবাজার -চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পীদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন মৌসুমী মৃৎশিল্পীরা, যারা সারাবছর দুর্গাপূজার আয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পীরা জানিয়েছেন, করোনায় প্রত্যেক মণ্ডপে পূজার বাজেট কমেছে। প্রতিমা বানানোর পর্যাপ্ত আদেশ এলেও এবার পরিধি অনেক ছোট। যারা বিভিন্ন ডিজাইনের বড় বাজেটের বড় বড় প্রতিমার বানানোর অর্ডার দিতেন, তারা এবার নামমাত্র মূল্যে ছোট প্রতিমা বানানোর অর্ডার দিচ্ছেন। এর ফলে দামও অর্ধেকে নেমে গেছে। মুনাফাও কম। অন্যান্য বছর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মৃৎশিল্পীরা অন্তত ৭-৮ কোটি টাকার প্রতিমা বানালেও এবার সেটা অর্ধেকে নেমে গেছে।

পঞ্জিকা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, আগামী ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে বোধন ও দেবী বন্দনার মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গাপূজা। পরদিন সপ্তমী তিথিতে পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল আয়োজন। ২৬ অক্টোবর দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আয়োজন শেষ হবে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দুর্গাপূজা আয়োজনের অনুমতি মিলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। পূজার মাত্র একমাস আগে গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজা আয়োজনের অনুমতি এসেছে, তবে আড়ম্বরপূর্ণ জনসমাগম এড়াতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বিভাগীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ‍কুমার পালিত জানিয়েছেন, এ বছর চট্টগ্রাম জেলায় ১৫২৭টি মণ্ডপে পূজা হবে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৫৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। গতবছরের চেয়ে এবার পূজার আয়োজন কমেনি, আঙ্গিকও ঠিক আছে। তবে আয়োজনের পরিধি কমেছে বলে জানান তিনি।

প্রতিবছর বাংলা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থেকে দুর্গাপূজার প্রতিমা তৈরি শুরু হয়। কিন্তু এবার আয়োজন নিয়ে সংশয় থাকায় শুরুর দিকে প্রতিমা তৈরির অর্ডার তেমন পাননি মৃৎশিল্পীরা। আশ্বিন মাস শুরুর পর থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে বলে জানিয়েছেন মৃৎশিল্পীরা। নগরীর দেওয়ানজি পুকুর পাড়, হাজারী লেইন, সদরঘাট, কাতালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন চলছে প্রতিমা তৈরির শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। পূজার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। শেষ মুহূর্তে তুলির আঁচড়ে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রতিমাগুলো।

চট্টগ্রাম মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতির সভাপতি রতন পাল বলেন, ‘দুর্গাপূজার অনুমতিটা একেবারে শেষদিকে এসেছে। অর্ডারগুলোও একেবারে শেষদিকে আমরা পেয়েছি। এজন্য আমাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্ডার পাই, এবারও পেয়েছি, অর্ডার কমেনি। কিন্তু পরিধিটা ছোট হয়ে গেছে। যিনি আগে এক লাখ টাকার প্রতিমার অর্ডার দিতেন, এবার তিনি দিয়েছেন ৩০ হাজার টাকার। অনেক মণ্ডপে পূজার জন্য নির্ধারিত প্রতিমার বাইরেও অতিরিক্ত প্রতিমা বানাতে হতো। এবার প্রতিমার এক্সট্রা অর্ডার আসেইনি। ব্যবসাটা অর্ধেক হয়ে গেছে।’

‘চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রতিমা তৈরির বড় প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৪০টি। মৌসুমিসহ মৃৎশিল্পী আছেন কমপক্ষে ৭০০ জন। আমরা সারাবছর এই ব্যবসাটার জন্য অপেক্ষায় থাকি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মিলিয়ে প্রতিবছর অন্তত তিন হাজার মণ্ডপের জন্য প্রতিমা বানিয়ে আট কোটি টাকার ব্যবসা হতো। এবার সেটা অর্ধেকও হবে কি না সন্দেহ। গত এপ্রিলে বাসন্তী পূজাও করোনার কারণে হতে পারেনি। অনেকে অর্ডার দিয়েও শেষ মুহূর্তে বাতিল করেন। সেই ব্যবসায়ও আমরা লস খেয়েছি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ বেশি। তাদের লোকসান বেশি। মৌসুমি শিল্পীরাও আয়বঞ্চিত হয়েছেন,’— বলছেন রতন পাল।

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মঠমন্দিরে হামলা হয়। সে বছর দুর্গাপূজা হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে দুর্গাপূজা হয়নি। এই দু’বার আমরা বড় ধরনের বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তবে এবার ব্যবসা কম হলেও আশা করছি অন্তঃত খেয়ে-পরে বাঁচতে পারব।’

মৃৎশিল্পী সুজন পাল বলেন, ‘মৌসুমি মৃৎশিল্পীদের লোকসানটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। সারাবছর তো আর প্রতিমা বানানোর কাজ থাকে না। অনেক শিল্পী গ্রামগঞ্জে ছোটখাট দোকান, ব্যবসা কিংবা চাকরি করেন। দুর্গাপূজার প্রতিমা বানিয়ে তারা একটু বাড়তি আয়ের মুখ দেখেন। সারাবছর এই আয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা। এবার সেই আয়টা তেমন হচ্ছে না।’

বিভিন্ন মণ্ডপের দুর্গাপূজার আয়োজকরাও জানিয়েছেন, এবার শুধু পূজার আনুষাঙ্গিকতাই থাকছে, উৎসব হচ্ছে না। প্রতিমার খরচ কমানোর পাশাপাশি আলোকসজ্জা, মঞ্চসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আরও বিভিন্ন আয়োজন সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেইন পূজা উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা জহরলাল হাজারী বলেন, ‘আমরা গতবছরও পূজায় ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছি। এবার বাজেট সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। গতবার প্রতিমা বানিয়েছিলাম ‍দুই লাখ টাকায়। এবার ৫০ হাজার টাকার প্রতিমার অর্ডার দিয়েছি। আমরা তো মানুষের কাছ থেকে অনুদান দিয়ে পূজা করি। করোনার সময়ে মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। অনুদানও পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বড় আকারে পূজার আয়োজন করলে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়ে যায়। স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেওয়া তখন সম্ভব হবে না। এসব বিবেচনায় আমরা আয়োজন সংক্ষিপ্ত করেছি।’

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নে ভবানীভবন মাতৃমন্দির কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তপন দাশ গুপ্ত বলেন, ‘আমরা গতবছরের প্রতিমা বিসর্জন দিইনি। এবার সেগুলো দিয়েই পূজা করছি। প্রতিবছর আমাদের মণ্ডপে পূজার পাশাপাশি নাটক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকে। এবার নাটক হচ্ছে না। আয়োজন সংক্ষিপ্ত করেছি।’

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিখিল কুমার নাথ বলেন, ‘উত্তরের উপজেলাগুলোতে ৭৬৯টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন হচ্ছে। তবে এবারের আয়োজন অনেক সংক্ষিপ্ত পরিসরে হচ্ছে। কী করব, মানুষের হাতে তো টাকা নেই। তাই শুধু পূজা ও ঢোলবাদ্য সহকারে আরতির মধ্য দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক মণ্ডপে যাতে বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়, সেই নির্দেশনা দিয়েছি।’

প্রতিমা ব্যবসায় ধসের বিষয়ে জানতে চাইলে পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত বলেন, ‘প্রতিবছর মণ্ডপগুলোর মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকে। এই প্রতিযোগিতার কারণে মৃৎশিল্পীরা তাদের বানানো প্রতিমার বাড়তি দাম পান। এবার প্রতিযোগিতা না থাকায় তারা সেই সুযোগটা হারিয়েছেন। এরপরও মৃৎশিল্পীরা যে বড় ধরনের আয়বঞ্চিত হচ্ছেন কিংবা তাদের ব্যবসায় যে লোকসান হচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’